” শঙ্খ ঘোষের প্রতিবাদের ভাষা ”
============================
শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন – ” আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রেমেরই কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রকৃতিতে যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় সহজ কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় দুরূহতায় যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় অলংকারে বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় নিরাভরণ হই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় ছন্দ ছেড়ে যাই ; আমার জন্য নির্ধারিত পথ রাখেনি কেউ, আমারও পথে চাই না আমি কাউকে। “
১৯৫১ সাল। কবি তখন মাত্র ১৯। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার বছর পেরিয়ে গেছে – মানুষ খবর পেয়েছে কিন্তু খাবার পায়নি। কোচবিহার কাঁপছে – খিদের একটা সুরাহা চায় তারা। মিছিল, পুলিশের কর্ডন। মিছিলের সামনে একটি ষোল বছরের মেয়ে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল – পুলিশ মেয়েটিকে কর্ডনের এপারে টেনে নিয়ে আসে এবং তারপর ‘ অবৈধ ‘ সীমালঙ্ঘনের অভিযোগে…
ওখানেই মৃত্যু হয় তার। তরুণ কবি প্রতিবাদ করলেন – রচিত হোলো কালজয়ী একটি প্রতিবাদের কবিতা ” যমুনাবতী ” – ‘ ….যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে/ বিষের টোপর দিয়ে। ‘
‘ দেশ আমাদের আজও কোনো ‘ কবিতাটি শুরুই হয় এইভাবে – জঙ্গলের মাঝখানে কাটা হাত আর্তনাদ করে/ গারো পাহাড়ের পায়ে কাটা হাত আর্তনাদ করে।
জরুরি অবস্থা। সঞ্জয় গান্ধীর বুলডোজার সহজেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে দিল্লিতে তুর্কমান গেটের কাছের বস্তি, সহজেই গুলি চলছে বাসিন্দাদের বুকে। তবুও সরকার- স্তাবকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শঙ্খ ঘোষ লিখলেন –
হাতের কাছে ছিল হাতেমতাই
চুড়োয় বসিয়েছি তাকে
দুহাত জোড় করে বলেছি ‘ প্রভু
দিয়েছি খত দেখো নাকে।
এবার যদি চাও গলাও দেব
দেখি না বরাতে যা থাকে —
আমার বাঁচামরা তোমারই হাতে
স্মরণে রেখো বান্দাকে !’….
(হাতেমতাই)
শঙ্খ ঘোষ খুব কম ক্ষেত্রেই কবিতার সন তারিখ উল্লেখ করেন।কিন্তু যদি বিশেষ কিছু বোঝাতে চান তখন সন উল্লেখ করতে ভুল হয় না।
এমনই এক ঘটনা- মরিচঝাঁপি, ১৯৭৮।
‘তুমি আর নেই সে তুমি ‘ – কবিতা রচিত হোলো- শেষে লেখা হোলো ১৯৭৮। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে –
তুমি বললে দন্ডকে নয়
আপন ভূমি চাই
আমি বললে ভন্ড, কেবল
লোক খ্যাপাবার চাঁই।
চোখের সামনে ধুঁকলে মানুষ
উড়িয়ে দেবে টিয়া
তুমি বললে বিপ্লব, আর
আমি প্রতিক্রিয়া।
তবে শুধু রচনা নয়। ২০০৩। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে এসপ্ল্যানেড চত্বরে ট্রামডিপোর পিছনেই সুরেন্দ্রনাথ পার্কের কিছুটা অংশে ” ভাষা উদ্যান ” র উদ্বোধন হয়েছে। সেখানে “লালন মঞ্চ ” তে শুরু হবে সেবারের বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব। আমাদের সবার অনুরোধে শঙ্খ ঘোষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবার সামনে আধ ঘণ্টা কবিতা পাঠ করবেন। মঞ্চের সামনে বসে আছেন
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মেয়র বিকাশরঞ্জণ ভট্টাচার্য, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। শঙ্খ ঘোষ সেদিন অনেকগুলি কবিতা পাঠ করেছিলেন। এরমধ্যে ” মন্ত্রীমশাই ” কবিতাটিও ছিল।সম্পূর্ণ কবিতাটিই আপনাদের পাঠের জন্য তুলে দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি :—–
মন্ত্রীমশাই
==============
মন্ত্রীমশাই আসবেন আজ বিকেলবেলায়।
সকাল থেকে
অনেক রকম বাদ্যিবাদন, পুলিশবাহার।
আমরাও সব যে-যার মতো জাপটে আছি
ঘরখোয়ানো পথের কোনা।
মন্ত্রীমশাই আসবেন আজ, তখন তাঁকে
একটি কথা বলব আমি।
বলব যে এই যুক্তিটা খুব বুঝতে পারি
সবাইকে পথ দেবার জন্য কয়েকজনকে সরতে হবে।
তেমন তেমন সময় এলে হয়তো আমায় মরতে হবে বুঝতে পারি।
এ-যুক্তিতেই ভিটেমাটির ঊর্ণা ছেড়ে বেরিয়েছিলাম
অনেক আগের রাতদুপুরে ঘোরের মতো
কণ্ঠাবধি আড়িয়ালের ঝাপটলাগা থামিয়েছিলাম
কম্বুরেখায় অন্ধরেখায় মানিয়েছিলাম
ছাড়তে হবে
সবার জন্য কয়েকজনকে ছাড়তে হবে।
কিন্তু সবাই বলল সেদিন, হা কাপুরুষ হদ্দ কাঙাল
চোরের মতো ছাড়লে নিজের জন্মভূমি!
জন্মভূমি? কোথায় আমার জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল!
দিন কেটেছে চোরের মতো
দিন ভিখারির ঘোরের মতো
পথবিপথে, জন্মভূমির পায়ের কাছে ভোরের মতো
জাগতে গিয়ে স্পষ্ট হলো
সবার পথে সবার সঙ্গে চলার পথে
আমরা শুধু উপলবাধা।
আমরা বাধা? জীবন জুড়ে এই করেছি?
দেশটাকে যে নষ্ট করে দিলাম ভেবে কষ্ট হলো।
এখান থেকে ওখানে যাই
এ-কোণ থেকে ওই কোণাতে
একটা শুধু পুরোনো জল জমতে থাকে
চোখের পাশে
আড়িয়ালের কিনার ঘেঁষে, কিন্তু তবু বুঝতে পারি
সবার জন্য এই আমাদের কয়েকজনকে সরতে হবে।
একটা কেবল মুশকিল যে মন্ত্রীমশাই
ওদের মতো সবার মতো এই ভুবনের বিকেলবেলায়
জন্মভূমির পায়ের কাছে সন্ধ্যা নেমে আসার মতো
মাঝেমধ্যে আমারও খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে-
তার কী করা?
——————————