স্বাধীনতার ৭৫ বছর ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ” ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে!”আজ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও কি আমরা বুঝতে পেরেছি “এ কোন ভারতবর্ষ !”কাজ কি কম হয়েছে? জনসংখ্যা, ধর্ম ও ভাষা – এই ত্রিশূলের উপর দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ যতটা উন্নতি করেছে তা কি অস্বীকার করা যায়? মনে রাখতে হবে ইংরেজদের শোষণের, দুর্ভিক্ষের, দেশ ভাগের, প্রাকৃতিক দুর্যোগের, নানান গোষ্ঠী কোন্দলের কারণে আমাদের অবস্থা তখন প্রকৃতপক্ষে করুন। কী ছিল আর কী হয়েছে কিংবা ৭৫ বছর স্বাধীনতার পর থেকেই বা কী কী ঘটতে চলেছে এবং তাতে আমাদের মত সাধারন মানুষের প্রকিতঅর্থে কী কী সুরাহা হতে চলেছে তার তালিকা তৈরি করতে বসিনি। কিন্তু সত্যি বলছি- খুব ভয়ে ভয়ে আছি- এই বেসরকারিকরণ, এই ধর্ম নীতি, এই ভিন্ন স্বর স্তব্ধ করার উৎসাহ, এই তালিবান, এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি — সব,সব আমাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে ! ভয়! ভয়! সেখানে কি একটা ছোট নদী এঁকে বেঁকে আমার গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাবে! নাকি উন্নয়নের উন্মাদনায় নদী-পাহাড়-জঙ্গল সব শহিদ হয়ে যাবে!! আমার গাঁ বিকশিত হবে শহরের ফুটপাতে কিংবা কোনো এন.জি.ও.র বিদেশি অনুদান পাবার প্রধান উৎস হিসেবে!!
ভয় হয়! ভয় হয়!
রবীন্দ্রনাথ যে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার ভিত্তি লুকিয়ে আছে তাঁর নিজস্ব ‘স্বদেশ ‘ ভাবনার মধ্যে। কেমন ছিল সেই স্বদেশ ভাবনা? কেমন ছিল তাঁর ‘সমাজ ‘ ভাবনা? এই প্রশ্ন গুলির উত্তর পেতে গেলে আবার আমাদের জানতে হবে ‘দেশ’ – এর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর নির্নয় কী ছিল। পরপর কয়েকটি উদ্ধৃতি মধ্য দিয়ে আমরা সেটা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। যেমন:-
১) দেশের যে অতি ক্ষুদ্র অংশে বুদ্ধি, বিদ্যা,ধন,মান, সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহা সমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি। আমরা এক দেশে আছি, অথচ আমাদের এক দেশ নয়।
২) ছেলেবেলা হইতে আমরা যে প্রণালীতে যে শিক্ষা পাই তাহাতে প্রতিদিন দেশের সহিত আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়া ক্রমে দেশের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহভাব জন্মে।
৩) দেশকে পাওয়ার মানে হচ্ছে দেশের মধ্যে আপনার আত্মাকেই ব্যাপক করে উপলব্ধি করা। আপনার চিন্তার দ্বারা, কর্মের দ্বারা, সেবার দ্বারা, দেশকে যখন নিজে গড়ে তুলতে থাকি তখনই আত্মাকে দেশের মধ্যে সত্য করে দেখতে পাই।
৪) যে লোক দেশের প্রত্যেক লোকের মধ্যে সমগ্র দেশকে দেখিতে পায় না,সে মুখে যাহাই বলুক দেশকে যথার্থভাবে দেখে না।
দেশের নেতা সম্মন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন —- তখনকার কালে একজন নেতা বলেছিলেন, আমার এক হাত ইংরেজ সরকারের টুঁটিতে, আর এক হাত তার পায়ে। অর্থাৎ কোনো হাতই বাকি ছিল না দেশের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে, বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বারবার ভারতবর্ষ ধর্মকে কীভাবে দেখে তা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন—-
” হাতের জীবন, পায়ের জীবন, মাথার জীবন, উদরের জীবন যেমন আলাদা নয় — বিশ্বাসের ধর্ম, আচরণের ধর্ম, রবিবারের ধর্ম, অপর ছয় দিনের ধর্ম, গির্জার ধর্ম এবং গৃহের ধর্মে ভারতবর্ষ ভেদ ঘটাইয়া দেয় নাই।ভারতবর্ষের ধর্ম সমাজেরই ধর্ম, তাহার মূল মাটির ভিতরে এবং মাথা আকাশের মধ্যে ; তাহার মূলকে স্বতন্ত্র ও মাথা কে
স্বতন্ত্র করিয়া ভারতবর্ষ দেখে নাই — ধর্মকে ভারতবর্ষ দ্যুলোকভুলোক ব্যাপী মানবের সমস্ত জীবন ব্যাপী একটি বৃহৎ বনস্পতি রূপে দেখিয়াছে। “
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই দর্শন, সেই আদর্শ, সেই দেশ তাঁর মৃত্যুর ৮০ বছর পরেও কি আমরা পেলাম? আমরা কি সত্যিই রবীন্দ্রভাবনায় জাড়িত হতে চেয়েছিলাম? ৭৫ বছরের স্বাধীন দেশ তাঁর সেই ভাবনার কতটুকু অনুসরণ বা বাস্তবায়িত করেছে? পরবর্তী সময়েই বা কতটুকু করবে?
প্রশ্ন আসতেই পারে — বাস্তবায়নের কোনো পথ কি তিনি বাতলেছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই পথের কথা, উপায়ের কথা উল্লেখ করে আজকের মতো ইতি টানছি।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন —
” তোমরা যে পারো এবং যেখানে পারো এক একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও।গৃহগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো।শিক্ষা দাও,কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো ; গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো এবং যাহাতে তাহারা নিজেরা সমবেত হইয়া গ্রামের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করে সেইরূপ বিধি উদ্ভাবিত করো। এই কর্মে খ্যাতির আশা করিয়ো না; এমনকি গ্রামবাসীদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে বাধা ও অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। ইহাতে কোনো উত্তেজনা নাই,কোনো বিরোধ নাই,কোনো ঘোষণা নাই ; কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃতে তপস্যা — মনের মধ্যে এই একটিমাত্র পণ যে, দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুঃখী তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত জীবন সমর্পণ করিব ।।